
নিজস্ব প্রতিবেদক: ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার সীমান্তবর্তী কামাল্লা গ্রাম। সেখানে এক খণ্ড জমিতে মাত্র দুটি গরু বাছুর নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন শরীফ, সুমন ও মুকুল — তিন বন্ধু।বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স সম্পন্ন করেও চাকরির পেছনে ছোটেননি তারা। চাকরি নয়, তারা চেয়েছিলেন গড়তে নিজেদের ভবিষ্যৎ, নিজের হাতে।
২০১২ সালে চার লাখ টাকার প্রাথমিক বিনিয়োগ নিয়ে শুরু হয় তাদের ‘ডেইরি ফার্ম’। দিনে দিনে সেই খামারই আজ পরিণত হয়েছে একটি কোটি টাকার প্রতিষ্ঠানে। এখন তাদের খামারে রয়েছে ৫৬টি উন্নত জাতের গরু — যেগুলোর বাজার মূল্য প্রায় ৯৫ লাখ টাকা। প্রতিদিন উৎপন্ন হয় ২০০ লিটার দুধ, যার প্রতিটি লিটার বিক্রি হয় ৭০ টাকা দরে। প্রতি মাসেই খামারটি থেকে লাভ আসে লক্ষাধিক টাকা।
তিন বন্ধু বলেন, “আমাদের কেউই চাকরির কথা ভাবিনি। আমরা বিশ্বাস করতাম, নিজেরা উদ্যোক্তা হওয়াটাই স্বাচ্ছন্দ্যের পথ। আর সেই বিশ্বাস থেকেই আমাদের শুরু।”
আজ তাদের খামার শুধু দুধ উৎপাদনে সীমাবদ্ধ নয়। তৈরি হচ্ছে ঘরে তৈরি দুগ্ধজাত পণ্য, গরু পালন করা হচ্ছে মাংসের জন্যও, এমনকি পুকুরে চলছে মাছ চাষ। তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে চেষ্টা করেছেন আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে।
তাদের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন ফেনী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু আল মানসুর। তিনি বলেন, “তিন যুবকই আমাদের দেশের যুব সমাজের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারা দেখিয়ে দিয়েছেন, শিক্ষিত তরুণরাও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিকে একটি লাভজনক পেশায় পরিণত করতে পারে।”
সরেজমিনে খামারটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, পরিচ্ছন্নতা ও পরিকল্পনার দিক থেকে এটি একটি মডেল খামার। খালি তৃণভূমিতে গরুরা চরে বেড়ায়, আর আধুনিক পদ্ধতিতে চলছে যত্ন-পরিচর্যা। কর্মচারীদের চেয়ে খামারিরাই বেশি পরিশ্রম করছেন — কারণ, তারা বিশ্বাস করেন, পরিশ্রমে লজ্জা নেই; বরং সেটাই সম্মানের।
তবে সব সফলতার পেছনে কিছু কষ্টের গল্পও থাকে। খামারি সাইফুদ্দীন আহমেদ চৌধুরী মুকুল জানান, “খামার পরিচালনায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো বিদ্যুৎ। শিল্প সংযোগের জন্য টানা তিন বছর চেষ্টা করেও সংযোগ পাইনি। বিদ্যুৎ ছাড়া খামার চালানো খুবই কষ্টকর।”
আরও একটি বড় সমস্যা হলো, সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়া। মুকুল বলেন, “কাগজে-কলমে ব্যাংক ৫ শতাংশ সুদে কৃষিঋণ দেয়, কিন্তু বাস্তবতা একেবারে উল্টো। যদি প্রকৃত কৃষকরা সহজ শর্তে ঋণ পেতেন, তাহলে আরও অনেকেই খামার গড়তে আগ্রহী হতেন।”
তিন বন্ধুর এই খামার এখন শুধু একটি ব্যবসা নয় — এটি বাংলাদেশের তরুণদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম। তারা প্রমাণ করেছেন, সৎ সাহস, পরিশ্রম আর দূরদৃষ্টি থাকলে গ্রামের মাটিতেও দাঁড় করানো যায় সাফল্যের রাজপ্রাসাদ।